কাঙ্গাল (সম্পূর্ণ গল্প)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৬:৫৭:১১ সন্ধ্যা
১.
একজন মধ্যবয়ষ্ক ভদ্রলোক।
ভদ্রলোক?
লেখার জন্য লিখা। সাধারণত মেয়েদেরকে অ্যাড্রেস করার সময় যেমন 'লেডিস' আর পুরুষদেরকে 'জেন্টেলমেন' বলা হয় তেমনি। না হলে ব্যক্তিগতভাবে তার কাছের মানুষদের কাছে তিনি 'চামার' হিসাবে পরিচিত।
একজন ভয়ঙ্কর শিক্ষিত চামার।
একটি বহুজাতিক কোম্পানীর ম্যানেজমেন্টের একটা ভাইটাল পোস্টে রয়েছেন। সুন্দরী বউ, রাজপুত্রের মতো ছেলে আর রুপসী রাজকন্যা। এদের সাথে উত্তরাতে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট এবং চোখে লাগার মত গাড়ী।
জীবনটা স্বপ্নের মতো কেটে যাবার কথা। আর দশজন মানুষের কাছে ঠিকই স্বপ্নের মত কাটত। কিন্তু তিনি বলে কথা!
সবার আগে অফিসে আসেন-যান সবার পরে। পান থেকে চুন খসার জো নেই। তিনি সাধারণত ক্ষমা করেন না। এই জিনিসটা তার কাছে নাই। এ জন্য আড়ালে তার একটা নাম আছে অধীনস্তদের কাছে। তাকে 'খতরনাক' নামে ডাকে সবাই। তিনি নিজেও জানেন। বেশ ভালোই লাগে। ওনার নিজেরও কিছু সোর্স আছে। এরা সকলের ভিতর ভাল মানুষটি সেজে বসে থাকে। এবং সময়ে অসময়ে বিভিন্ন তথ্য পাচার করে। সব অফিসের বসদেরই এমন দুয়েকজন থাকে।
আজ সকাল থেকেই তার মনটা অস্থির হয়ে আছে। এরকম সাধারণত হয় না। তিনি বেশ গোছানো মানুষ। তার প্রতিটি কাজই সময় ধরে মেপে মেপে করা। আর আসবাবপত্র থেকে চিন্তাধারা পর্যন্তও একই নিয়মে চলে। কিন্তু আজ কেন এই অস্থিরতা?
সুন্দরী পিএস দু'বার এসে বসের ভ্রু কোঁচকানো দেখে দূর থেকেই ফিরে গেছে। সেও অবাক হল! এমন কখনোই হয়নি। বসের চেহারায় কখনো কোনো ভাব ফুটে উঠে না। যেন পাথরের মুর্তি। এর আগের অফিসের বসের মত নন ইনি। সে চোখ দেখলেই পুরুষের ভিতরের কামুক দৃষ্টিকে চিনতে পারে। পিএস হিসাবে তো এক-দু'দিন চাকুরি করছে না। তবে এই বসের ভিতরে সুক্ষণ একটা মার্জিত বোধ রয়েছে। যদিও বাহিরের খোলসটা কেমন যেন কর্কশ টাইপের।
সবুর সাহেবের মাথার এক তৃতীয়াংশ চুল সাদা হয়ে গেলেও তিনি কলপ লাগান না। জুলফির দু'পাশের যায়গাগুলোতে একবার দিয়েছিলেন। শিয়ালের লেজের মত লালচে রং ধারণ করেছিল মেহেদী দেওয়াতে। সেই থেকে বেশ ক'দিন নিজেকে শিয়াল শিয়াল মনে হয়েছিল। কয়েকবার চেম্বারে বসে 'হুক্কা হুয়া' ডাক দিতেও মন চেয়েছিল তখন।
বাসায় মেয়েটার সাথে কথা বলবেন কিনা ভাবলেন। ছেলের সাথে তো তার সাথে কথা হয়ই না বলতে গেলে। ছেলে তার একা একা জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সব ধরণের অপুর্ণতা থেকে ছেলেকে তিনি মুক্ত রেখেছেন। নিজের জীবনের ছেলেবেলার সেই অভাবকে তিনি এখনো ভুলেন নাই। ক্ষুধার কষ্টকেও না। কতদিন না খেয়ে থেকেছেন...
সেই জন্য একটা জেদ ছিল জীবনে। অনেক বড় হবার। প্রচুর টাকা কামাবার। সেটা করেছেনও। কিন্তু নিজের জীবনের অপুর্ণতাকে ছেলে-মেয়ের জীবনে পুর্ন করতে গিয়ে কি হল? তিনি নিজেই ওদের থেকে বিচ্ছিন্ন হলেন। বাবাকে ওরা যখন পাওয়ার দরকার ছিল, তখন তিনি অনেক ব্যস্ত। দেবার মত সময় তার কাছে ছিল না। তার বউ কত অপেক্ষা করেছে... অনেক রাত... তার জন্য। কিন্তু জীবনের অতিরিক্ত কিছু চাহিদাকে পুরণ করার জন্য দিনভর পরিশ্রম করে ক্লান্ত তিনি, পারেন নাই বউ-বাচ্চাদের সময় দিতে। এভাবেই দূরত্তের সৃষ্টি। বউও নিজের জীবনকে অন্যভাবে সাজিয়ে নিলো। কিটি পার্টিতে নিজেকে ব্যস্ত রাখে সে এখন।
আজ মন খারাপের এক দুপুরবেলায় সবুর সাহেব হঠাৎ আবিষ্কার করেন, এমন কেউই নাই যার সাথে তিনি একান্তে একটু মনের কথা বলে হাল্কা হবেন!!
কেউই নেই?
২.
ছেলের কাছে ফোন করলেন। অনেক্ষণ রিং বেজে বেজে একসময় বন্ধ হয়ে গেল। নিজের কাছে খুব অপমানিত বোধ করলেন। একটা জেদ চেপে গেল। আবার ডায়াল করলেন। তিনবার রিং হবার পরে ওপাশ থেকে কথা বলল-
: হ্যালো!
: হ্যালো। কি ব্যাপার ফোন ধরছিস না কেন?
: একটু ব্যস্ত ছিলাম পাপা। বল কি বলবে?
: এমনি ই ফোন করলাম। তোর সাথে কথা বলি কিছুক্ষণ?
: তোমার শরীর ভালো তো!
: কেন? শরীর ভাল খারাপের প্রশ্ন আসছে কেন?
: না, এমনিই মনে হল। রাগ করছ কেন পাপা?
: রাগ হবার মত কথা বলেছিস তাই হচ্ছি। পড়াশুনা কেমন চলছে?
: ভাল। তুমি জান আমি ভাল স্টুডেন্ট। অতিরিক্ত ভাল।
: হ্যা। - একটু উজ্জ্বল হলেন তিনি। ছেলের জন্য ভিতরে ভিতরে গর্ব করেন।
: আর কিছু বলবে? আমার কিছু কাজ ছিল...
ছেলের কথায় আহত হলেন। কিছু না বলে লাইন কেটে দিলেন। এটাও যে একটা চামারের ব্যবহার, সেটা এইমুহুর্তে তিনি ভুলে গেলেন। বুকের বাম পাশে একটু চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলেন। গলার টাইয়ের নটটা একটু ঢিলে করে দিয়ে এসির রিমোট হাতে নিলেন। আরো শীতল হতে হবে। কিন্তু এ শীতলতা যে তার ব্যবহারেও পুরোপুরি এসে গেছে, সেটা কখনো তিনি ভাবেন না।
কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইলেন।
একটু সুস্থির হতেই মেয়ের কাছে ফোন করলেন। রিং হতেই মেয়ে ধরে-
: হ্যা, বাবা। বল।
: কেমন আছিস মা?
: ভাল। তুমি এই সময়ে ফোন করলে যে?
: কেন আমি করতে পারি না?
: পারো। তবে কখনো কর না তো, তাই জিজ্ঞেস করলাম।
: এখন থেকে করব। তোমার মা কোথায়?
: নানুর বাসায়। আজ ছোট মামার বাসায় কি যেন আছে। সেই জন্য ব্যস্ত। তুমি কিছু বলবে বাবা?
: কেন রে মা? কিছুক্ষণ কথা বলি?
: আচ্ছা।
্
কিন্তু মেয়ের এই ‘আচ্ছা’ বলার ভিতরে তিনি যে সুর চেয়েছিলেন, তা পেলেন না। বুঝলেন, মেয়ে ছেলের মত সরাসরি তার অনীহা প্রকাশ করছে না। তবে জোর করে সে তার বাবাকে সময় দিতে চাচ্ছে। মনটা তেতো হয়ে গেল। এবার মেয়েকে, ‘রাখি মা’ বলেই ফোনটা রেখে দিলেন।
টাইটা এবারে খুলেই ফেললেন। ভিতরে ভিতরে একটা প্রচন্ড রাগ তৈরী হচ্ছে বুঝতে পারছেন। উত্তেজিত হওয়া তার জন্য একেবারেই নিষেধ। বেল চেপে পিওনকে ডেকে বরফ দিতে বললেন। উত্তেজনা কমাতে একটু গরম কিছুই দরকার। সাধারণত দিনের বেলায় তিনি ড্রিঙ্ক করেন না।
তবে আজ করবেন।
নিজের কাছ থেকে নিজে হারিয়ে যাচ্ছেন। ফিরে আসা প্রয়োজন।
নিজেদের কাছে!
৩.
সবুর সাহেবের পিএস মেয়েটি অনেকক্ষণ চেম্বারের বাহিরে অপেক্ষা করল। সে বুঝে উঠতে পারছিল না তার বসের আজ কি হয়েছে। সে এই কোম্পানীতে প্রায় দুই বছর আছে। কিন্তু আজকের মত রুটিনের হেরফের হতে দেখেনি। এরপর পিওন রমিজ বরফ এবং সোডা নিয়ে সেই যে বসের রুমে ঢুকেছে, এখনো বের হবার নাম নাই। কিছু জরুরী পেপারস রয়েছে। তার ওপর বাহিরের ডেলিগেটদের কিছু ইম্পরট্যান্ট কল আসছে। কিন্ত এই মুহুর্তে ভিতরে যাওয়া কিংবা লাইন ট্রান্সফার করা কোনোমতেই সম্ভব নয়।
আরো আধা ঘন্টা পরে রমিজ বের হল। ওর পাশ দিয়ে যাবার সময় ওকে ভিতরে যাবার জন্য ইশারা করে গেল।
সবুর সাহেব তার লিমিট পার করেন নাই। উত্তেজনা কমানোর জন্য একটু লাইট ফিলিং দরকার ছিল। তার ওপর দিনের বেলা। আর এটা অফিস। সেই খেয়ালও রয়েছে। সব দিক মিলিয়ে তিনি সামাল দিয়েছেন। পিএস কে দেখে বললেন,
: এসো রিমি। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে রাখলাম।
: ইটস ওকে স্যার।
: তেমন জরুরী কিছু থাকলে আগে সেগুলো দাও।
রিমি পেপারসগুলো এগিয়ে দিলো। স্বাভাবিকভাবেই সবুর সাহেব সাইন করে দিলেন। ওয়াইনের হাল্কা একটা ঘ্রাণ রিমি পাচ্ছিল। তবে স্যারের শরীরের ঘামের সাথে পারফিউম মিশে আলাদা এক ঘ্রাণ বের হচ্ছে। তার সাথে ওয়াইনের ঘ্রাণ- সব কিছু মিলিয়ে ওর মেয়েলি ইন্সটিঙ্কট বলছিল, এটা সহ্য করার মত। তেমন খারাপ কিছু নয়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বসের কার্যকলাপ সে দেখতে লাগল।
সবুর সাহেবও রিমির পর্যবেক্ষণ দেখে মনে মনে হাসছিলেন। এই মেয়েটি অসম্ভব বুদ্ধিমতি। এবং সুন্দরী। দশে সাড়ে আট পাবার মত মেয়ে। দেড় মার্ক কেন বাদ দিবেন ভেবে পেলেন না। তিনিও সেই স্কুল জীবনে বাংলা হাতের লিখা খুব সুন্দর লিখেও মফিজ স্যারের কাছ থেকে কখনো দশে সাতের বেশী পান নাই। তবে তারটাই ছিল হাইয়েস্ট। ঠোটের কোণে মুচকি হাসি এসেই মিলিয়ে গেল। আড়চোখে রিমির প্রতিক্রিয়া কি সেটাও দেখে নিলেন।
তার নিজের মেয়ের মতই দেখেন ওকে।
আচ্ছা মেয়েটি কি সেটা জানে?
ওকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়? পরক্ষণেই ভাবনাটা বাতিল করে দিলেন। এতে করে তার যে গাম্ভীর্যের মুখোশটা এতদিন গড়ে উঠেছে, সেটা নষ্ট হয়ে যাবে। আর একবার নষ্ট হলে দ্রুত তাতে পচন ধরবে। মেয়েটির বুদ্ধিটাকে আর একবার পরখ করে নিতে ইচ্ছে হল। ফস করে জিজ্ঞেস করলেন-
: রিমি!
: স্যার?
: তুমি কি আমাকে পচ্ছন্দ কর? নাকি অন্য সবার মত আমাকে তুমিও ‘খতরনাক’ ডাক?
রিমি একটু থেমে কি বলবে গুছিয়ে নিল।
: স্যার, আমি অবশ্যই আপনাকে পছন্দ করি। না হলে আপনার সাথে দুই বছর জব করতে পারতাম না।
: গুড! নেক্সট?
: আর আমি আপনার পিএস। অন্য সবাই এ জন্য আমাকে আপনার খাস লোক মনে করে দূরে থাকে। তারাও আমার কাছে কিছু শেয়ার করে না। আর এ জন্যই আমারও কিছু শেয়ার করা হয় না তাদের কাছে।
: ভেরী গুড!
কিছুক্ষণ সরাসরি রিমির চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সেও স্যারের দিকে একটু সময় তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে নিল। বুঝল এটা একটা খেলা। যে খেলায় বস জিততে চাইবেন। তাই সে ইচ্ছে করেই হেরে গেল।
মনে মনে আরো একবার হাসলেন সবুর সাহেব। মেয়েটি যে ইচ্ছে করেই তার কাছে হার মানলো সেটাও বুঝেছেন।
: শোন রিমি।
: স্যার?
: আমি আজ এখনই বের হব। আজ ফিরছি না। আমার সমস্ত এপয়েন্টমেন্ট ক্যান্সেল কর।
: ওকে স্যার। তবে জার্মানীর ডেলিগেট আপনার সাথে ভিডিও কনফারেন্সে বসতে চাইছে।
: কখন?
: আপনি চাইলে এখনি সম্ভব।
: ওকে। অ্যারেঞ্জ ইট ইমিডিয়েটলি। আইল গিভ অনলি থার্টি মিনিটস।
: ইয়েস স্যার।
সবুর সাহেব মোবাইলের বাটন নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন। তার ওয়াইফের সাথে এখনো কথা বলা বাকী আছে। তারপর একটা ডিসিশন নিবেন।
একটু উত্তেজনা বোধ করলেন!
৪.
ভিডিও কনফারেন্স শেষ হল।
অনেকটা তৃপ্তি নিয়ে নিজের চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে বসে আছেন।
কিন্তু এই তৃপ্তি তার অফিসিয়াল কিছু একটা অর্জনের। সেখানে তিনি থাকলেও তার নিজের একান্ত কিছু নেই।
তাই মনের ভিতর যে কষ্টটা নিয়ে অফিসে এসেছিলেন, সেটা রয়েই গেল।
সংসার জীবনে তার এত অবদানের পরেও প্রিয় মানুষদের কাছে তিনি কেন জানি অনেক দুরের মানুষ। একজন আউটসাইডার। আজ পর্যন্ত তাকে একজনও বলল না, ‘ আমি তোমাকে ভালবাসি’। অথচ দিনের পর দিন, রাতের পর রাত তাদের জন্য পরিশ্রম করেছেন। বিনিময়ে চেয়েছেন তাকে ওরা ভালবাসুক।
নাকি তিনি ওদের ভালবাসাকে বুঝতে পারছেন না?
এমনও তো হতে পারে।
ভালবাসাটা এক একজনের কাছে এক একরকম। তাই তার প্রকাশভঙ্গীও ভিন্ন। কিন্তু তিনি এমন কোনো গাধা টাইপ নন যে, মানুষের ভালবাসার ফীড-ব্যাক বুঝতে অক্ষম। তাকে তো আর এই কোম্পানির এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর চেহারা দেখেই বানানো হয় নাই।
বউ এর কাছে ফোন করলেন। ফোন ধরে ওপাশ থেকে মিষ্টি কন্ঠে কেউ বলল,
: হ্যালো
: হ্যালো, কোথায় তুমি?
: এটা জানার জন্যই কি ফোন করেছ?
: সোজা কথায় উত্তর দিতে জান না?
: না, জানি না।... বল কি বলবে?
: বলার মুড রেখেছ কি?
: মুড ঠিক করে নাও। তুমি তো সবই পার।
: কি বোঝাতে চাইছ? আমি তোমার সাথে ঝগড়া করার জন্য ফোন করি নাই।
: সেটাই তো ভাবছি! কীভাবে সময় বের করলে?
: কখনো ভেবেছ কি কেন সময় পাই না বা কীভাবে আছি?
: আজ সুর্য কোন দিক থেকে উঠেছে!
: উপহাস করছ?
: না। তোমার সাথে সেটা করার মত সময় এখন আমারও নাই।
: কেন? কি এমন ব্যস্ত তুমি? আমি সারাটা দিন কীভাবে কাটাই, জিজ্ঞেস করেছ কোনো দিন?
: তোমাকে জিজ্ঞেস করার অনেক মানুষ আছে। ... কেন, তোমার সুন্দরী পিএস এর কি হল?
: ইউ বিচ!
: ইয়েস। কিন্ত আমাকে বিচ এ পরিণত করেছ তুমি! দিনের পর দিন... একা একা রেখেছ। একটু কথা বলতে চেয়েছি, তোমার সময় হয় নি। রাতের পর রাত অসহ্য যন্ত্রনা নিয়ে জেগে থেকেছি। তোমাকে একটু টাচ করতেই কুকুরের মত খেঁকিয়ে উঠেছ। নাউ ইউ আর অ্যাড্রেসিং মি অ্যাজ আ বিচ?
: আমি কি আমার জন্য এ সব করেছি? তোমাদের...
: না, আমাদের জন্য না। তোমার জন্য... তোমার জেদের জন্য তুমি অনেক দূরে চলে গেছ। আজ তোমার ছেলে- মেয়ে তোমার থেকে দূরে নিজেদের আলাদা জগতে। একই বাড়িতে থেকেও তুমি কি জানো তোমার ছেলের রুমের জানালার কার্টেনের কালার কি? মেয়ের পড়ার টেবিলটা কেমন? কিংবা আমার মুখের তিলটা ডান না বাম পাশে?
: এটা দেখা আমার কাজ না।
: তাহলে কেন এখন দেখতে এসেছো?
: আমাকে কখনো বলেছ, ভালবাস আমাকে?
:স্যরি? আবার বল তো?
: আমার খুব শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে কেউ আমাকে বলছে, আই লাভ ইউ!
: তোমার তো অনেক টাকা, পাওয়ার। যাও, ভালোবাসা কিনে নাও। ... তুমি নিজে ক’বার কাউকে বলেছ এই কথা? এই আমাকে?
: বলি নাই। হয়ত সময় পাই নাই। হয়ত... এখন বলতে চাই! শুনতে চাই!
: নাউ ইটস ঠু লেইট! আমার মন মরে গেছে। সেই আমি আর নাই।
: আমি আবার তোমাকে আগের মত করে নেব। আমি...
: তোমার টাকা দিয়ে? হাহ হা হা... আমি ফোন রাখছি। আমাকে বের হতে হবে...
বউ ফোনটা রেখে দিল।
বজ্রাহতের মত সবুর সাহেব বসে রইলেন। তার পৃথিবী একেবারে নীরব। তিনি বুঝে ঊঠতে পারলেন না কি হল ? যে আশাটুকু মনের ভিতর সুপ্ত ছিল, এই মুহুর্তে সেটুকুও মিইয়ে গেল। হতাশা আর ক্রোধে ছটফট করতে থাকলেন। কিন্তু বাহিরে সেই নির্লিপ্ত ভাব রয়েই গেল।
একজন এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টরের নির্লিপ্ততা!
৫.
সবুর সাহেব ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস নিলেন।
না, তার রাগ হওয়া চলবে না। কিন্তু যতই তিনি নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছিলেন, উত্তরোত্তর রাগ বেড়েই চলছিল। ইচ্ছে হচ্ছিল এখুনি বাসায় যেয়ে সব ছারখার করে ফেলেন।
তার মাথার ভিতরে বউ এর বলা ,’ তোমার তো অনেক টাকা, পাওয়ার... যাও, ভালোবাসা কিনে নাও‘ – কথাগুলো বার বার ব্রেইনে বেজে চলছিল।
হ্যা, ভালোবাসা কিনেই নিবেন তিনি।
রিমিকে ডেকে সব কিছু বুঝিয়ে দিলেন।
নীচে নেমে গাড়ির কাছে আসতেই ড্রাইভার এগিয়ে এল। তাকে হাতের ইশারায় নিষেধ করে নিজেই ড্রাইভিং সীটে বসলেন।। ড্রাইভার নিজের জায়গায় অবাক দাঁড়িয়ে রইল। ওর এই বসের সাথে এতো বছরের ক্যারিয়ারে এই প্রথম উনি নিজে গাড়ী নিয়ে বের হলেন।
গাড়ী নিয়ে ইতস্ততঃ এদিক সেদিক ঘুরতে থাকলেন।
কোথায় যাবেন ঠিক করতে পারছেন না। রায়হানের অনেক আগের একটা কথা হঠাৎ করে মনে আসতেই ব্রেকে পা চেপে ধরলেন। রাস্তার সাইডে গাড়ী পার্ক করে রায়হানের মোবাইল নাম্বারটা বের করলেন। মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। নিষিদ্ধ কি এক আসন্ন অনুভুতি লাভের আশায় তিনি মনে মনে হাসতে লাগলেন।
আধাঘন্টা পরে...
রাজধানীর একটি অভিজাত এলাকায় একটা ছিমছাম বেড রুম। সবুর সাহেব বসে আছেন। ট্রে হাতে নিয়ে যে মেয়েটি রুমে প্রবেশ করল, দেখতে শুনতে সে খারাপ না। দশে ৫ এর উপরে নাম্বার পাওয়ার মত। শরীর এবং রূপে অনন্যা। তবে সে একজন হাই রেটেড কর্ল গার্ল। তাই তাকে তিনি কোনো নাম্বারের ভিতরে ফেলছেন না। সহজ ও স্বাভাবিক ভাবে সে এসে সবুর সাহেবের সামনের কার্পেটে বসল। বলল,
: আমাদের এখানে সব কিছুই পাওয়া যায়। আপনি কি নিবেন?
: সব কিছু বলতে যদি ওয়াইন হয় আমার প্রয়োজন নেই।
: কিছুই নিবেন না?
: ব্ল্যাক কফি?
: সিওর।
: ইফ ইউ প্লীজ?
মেয়েটি কফি নিয়ে যখন ভিতরে এলো তার বেশভুষায় হাল্কা পরিবর্তন দেখতে পেলেন। এখন একটু উত্তেজক পোশাক পরে এসেছে। একেবারে নগ্নও নয়। তবে শরীরের অনেক কিছু দেখা যাচ্ছে যা দেখা উচিত নয়। সে এবার সবুর সাহেবের কাছ ঘেষে বসল। মেয়েলি শরীরের ঘামের সাথে হাল্কা একটা পারফিউমের ঘ্রান পেলেন। সাথে পাউডারেরও। একটু খারাপ লাগলো সবুর সাহেবের। এক পলকে তার রাজপুত্র ও রাজকন্যা রূপী ছেলে-মেয়ে দুটির কথা মনে পড়ে গেল। সেই মুহুর্তেই মেয়েটি তার কাঁধে হাত রেখেছে- সবুর সাহেবের কি যে হল! তিনি একটু জোর করেই মেয়েটির হাত সরিয়ে দিলেন।
আহত দৃষ্টিতে মেয়েটি তার দিকে তাকিয়ে বলল-
: এই জন্যই কি আপনি এখানে আসেন নাই?
: স্যরি! বাট আই নীড টাইম... প্লীজ।
: ওকে।
আসলে তিনি এসেছিলেন একটা ঝোঁকের মাথায়। কিন্তু এখানে এসেই এখন কেমন সব গোলামাল হয়ে যাচ্ছে। আবার বউ এর কথাগুলো মাথায় বেজে উঠতেই তিনি মেয়েটিকে কাছে ডাকলেন। বললেন,
: শোন, আমি তোমাকে পে করেছি। কিন্তু আমার অন্য জিনিস চাই।
: কি জিনিস? কি চান? ... কি ভাবে...
: না, না- তুমি যা ভাবছ তা নয়। আমি... আমি কিছুক্ষণ সময় তোমার সাথে কাটাতে চাই... আমি... ড্যাম ইট! আই জাষ্ট ওয়ান্ট ইউ লাভ মি!
: হ্যা, আমি তো সেটাই করতে চাচ্ছি।
: ওহ! হাউ কুড আই রিয়ালাইজ ইউ? আই ওয়ান্ট ইউ জাষ্ট টেল মি, ইউ লাভ মি!
মেয়েটি একটু ছিটকে সরে গেলো। কিছুটা আহত স্বরে বলল,
: ইউ ক্রেইজী? আমি এখানে শরীর বিক্রি করতে এসেছি। আমার মন না। আর... সেটা আছে কি নেই আমি নিজেই জানি না!
এত বড় একটি মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানীর একজন এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর, একজন কল-গার্লের কাছ থেকে ভালবাসি শব্দটা শুনতে চাচ্ছেন! কিন্ত তার ব্রেইন এবং হৃদয়-দু’জায়গাতেই অনবরত বেজে চলছিল...‘টাকা দিয়ে ভালোবাসা কিনে নাও’...’টাকা দিয়ে... কিনে নাও'
মেয়েটি তাকে একজন মধ্যবয়ষ্ক উন্মাদ মনে করে এবার একটু ভয় পেল। তবে তার এ রকম অনেক কাস্টোমার দেখা আছে, যারা একটু অন্য ভাবে নারী দেহকে উপভোগ করতে চায়। এজন্য সে বিশেষ ঘাবড়াল না। শুধু পর্দা উন্মোচনের অপেক্ষায় রইলো।
... ...
সবুর সাহেব একটা ঘোরের ভিতর রয়েছেন। এমনিতেই তিনি ভীষণ জেদী। কিন্তু কখনো নিজের কান্ড জ্ঞান হারান নাই। যেটা আজ হারাতে চলেছেন। জীবনে এই প্রথম।
কল-গার্ল মেয়েটি এখন সবুর সাহেবকে আর ভয় পাচ্ছে না। সে মোটা অঙ্কের আরো কিছু টাকা যা তার রেটের বাহিরে হাতিয়ে নেবার জন্য লোভী হয়ে উঠল। এই লোকের যে অনেক টাকা সেটা সে তার মেয়েলি ইন্সটিঙ্কট দিয়ে বুঝে ফেলেছে। সিদ্ধান্ত নিল সে। এই লোকের নিয়মেই সে খেলবে। সে একটা মোটা অঙ্কের টাকা চাইল। সবুর সাহেব রাজী হলেন।
আরো দু’কাপ কফি খেলেন। মেয়েটি এখন তার খুব পাশ ঘেষে। মেয়েটি ওর নিজের জীবনের কিছু কথা বলে চলেছে। সত্য-মিথ্যায় ভরা। সবুর সাহেব চুপ করে শুনছেন। কিন্তু যে কথাটি তিনি শুনতে চাচ্ছেন সেটা কোনো ভাবেই আসছে না। তিনি মেয়েটিকে থামালেন। বললেন,
: তোমাকে আমি এতোগুলো টাকা দিচ্ছি। কেন?
: কারণ আপনি আমার কাছে এসেছেন।
: কিন্তু আমি তো তোমার সাথে কিছু করছি না।
: আপনাকে আমি সময় দিচ্ছি। এই সময়ের দাম দিচ্ছেন আপনি।
: আমি যে শুধু শুধু তোমাকে সামান্য সময় কাটানোর জন্য পে করছি... একটা হ্যান্ডসাম এমাউন্ট... তুমি কি এ জন্য আমাকে কিছু বলবে?
: হ্যা!...
সবুর সাহেব উত্তেজনায় কেঁপে উঠলেন। এখুনি শুনবেন তার আরাধ্য সেই শব্দটি। তার ব্রেইনে ঘুরপাক খেতে থাকা বউর শব্দ ক’টি এই মুহুর্তেই মিলিয়ে যাবে কল-গার্ল এই মেয়েটির কথায়। কিন্তু তার ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণিত করে মেয়েটি বলে উঠল-
: থ্যাঙ্কস।
: অনলি থ্যাঙ্কস!?
: হ্যা। কেন? আসলে আপনি যেটা চাচ্ছেন, সেটা জোর করেও বলা সম্ভব নয়। আমার নিজের কাছেই কেমন লাগছে।
উত্তেজনায় বসা থেকে সবুর সাহেব উঠে দাড়ালেন। একটু একটু কাঁপছেন। সর্বগ্রাসী এক ক্রোধ তাকে ঘিরে ফেলছে। কিন্তু মেয়েটি বলেই চলেছে-
: আমি এরকম অনেককে দেখেছি। ওয়াইফের কাছ থেকে ভালবাসা না পেয়ে আমাদের কাছে আসে একটু ভালবাসা পেতে। কিন্তু আমরা তো শুধু শরীরের ক্ষুধা মেটাতে পারি। আসেন আপনাকে একটু আনন্দ দেই...
সবুর সাহেব প্রচন্ড একটা চড় কষালেন মেয়েটির গালে।
ফলে সে ছিটকে বিছানার উপর পরে গেল।। বেশ জোরেই মারা হল। ওর ঠোটের কষা বেয়ে ব্লাড বের হচ্ছে। দেখে তার নিজের ভিতর থেকে কিছু যেন একটা কি যেন হিংস্র-আদিম উল্লাসে বের হয়ে এলো। এতদিনের না পাওয়া ইচ্ছে- সকলের অবহেলা- ছোটবেলার বঞ্চনা, ক্ষুধার কষ্ট- বউয়ের ঘৃনা মেশানো কটাক্ষ - এখনকার জীবনের সব কিছু থাকার পরেও একাকীত্ত-এই সবগুলো মিলিয়ে একটা চাপা ক্রোধ মেঘের গর্জন নিয়ে মেয়েটির উপর ঝাপিয়ে পড়তে বাধ্য করল হিংস্র মানুষের মতন। নিমিষে ওর সমস্ত কাপড় ছিড়ে ফেললেন। একটা পেশাদার বারবনিতা এই মধ্য বয়ষ্ক মানুষটির হিংস্রতা দেখে নিজেকে গুটিয়ে নিতে চাইল। ও যেন সেই প্রথম দিনের অনাঘ্রাতা কুমারি মেয়েতে ফিরে গেল। ওর অনুভুতির মাঝে। কিন্তু রক্তের স্বাদ পাওয়া মানুষের জিঘাংসা চরিতার্থ করায় সে কিভাবে বাঁধা দিতে পারে।
প্রচন্ড কাল বৈশাখী ঝড়ের পরে ...একসময় প্রকৃতি শান্ত হয়ে এলো। তবে তখন সব কিছু লন্ড-ভন্ড।
ভাবলেশহীন মেয়েটি নির্বোধ সবুর সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইলো।
শুধু একবার বললে, ‘ছি!’
তারপর তার পা’র কাছে একবার থুথু ফেলে মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিল।
বিধ্বস্ত – ভাঙাচুরা একজন মানুষের মত টলতে টলতে উত্তরার সেই ফ্ল্যাটটি থেকে সবুর সাহেব যখন বের হলেন, সুর্য তখন অস্তমিত প্রায়। অস্তমিত সুর্যের দিকে তাকিয়ে তিনি উপলব্ধি করলেন, তার যেটুকু অবশিষ্ট ছিল। আজ এই সুর্যের ডুবে যাবার সাথে সাথে শেষ হয়ে গেছে।
এই মুহুর্ত থেকে তিনি আর কারো চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকার সক্ষমতা হারালেন।
সব কিছু থেকেও তার কিছু নেই।
এই বাড়ীটার ভিতরে তিনি তার সর্বশেষ কপর্দকও হারিয়ে এসেছেন।
এখন একজন নিঃস্ব মানুষ তিনি।।
(সমাপ্ত)
বিষয়: সাহিত্য
১৯২৮ বার পঠিত, ১২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আর প্রিয়তে রাখার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।
সবুর সাহেবের মত লোকেরা আজ আমাদের সমাজপতি। মদ, নারী এবং নিজের ভিতরে শূন্য-খোকলা অনুভূতিকে ঢেকে রাখতেই তাঁরা সদা ব্যস্ত। সমাজের নেতৃত্ব কিভাবে দিবেন?
ভালো থাকবেন।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
আফরার লিখাটা মনে আঘাত করে। কিন্তু আপনারটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আর মনে তো আঘাত করেই সেই সাথে সামাজিক অবস্থার চিত্র ও ফুটে উঠে।
নান্দনিক মন্তব্যের জন্য অনেক শুভেচ্ছা।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
ইনশা আল্লাহ এরপর থেকে পর্বাকারে দেবার চেষ্টা করব।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
বড় বড় সব পূঁজিপতিদের অধিকাংশই কপর্দকশূন্য-
সব কিছু থেকেও তাদের কিছু নেই-
তারচেয়ে কঠিন সত্য-
তারা বোঝেই-না যে তারা কপর্দকশূন্য
ভালো লাগলো-
তবে শেষে সবুর সাহেবকে নিঃস্ব/কপর্দকশূন্য না করে ব্যতিক্রমী ভালোমানুষ করে তুললে সমাজের বেশী কল্যান হতো মনে করি!!
অনেক ধন্যবাদ এবং সাথে থাকার জন্য শুভেচ্ছা।
সহমত আপনার সাথে।
লিখবার সময়ে পজিটিভ দিকটি কেন যে মনে এলো না!
ইনশা আল্লাহ এরপর থেকে খেয়াল রাখব।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
মদিনা মুনাওয়ারায় প্রিয় বাবার সাথে দেখা হয়ে মিশেল অনুভূতি নিয়ে ফিরে আসলাম আপন কর্মস্হলে। বাবার কাছে এবং রওজা মোবারকে আপনার সালাম পৌছে দিয়েছি মামুন ভাই।
অনেক অনেক শুভেচ্ছা এবং মোবারকবাদ আপনার জন্যও রইলো।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন